:: হেলাল হোসেন কবির ::
১৭ ডিসেম্বর ২০১২ সাল। রাত দশটায় পেশাগত দায়িক্ত পালন শেষে লালমনিরহাট শহর থেকে মকড়া ঢঢ গাছ গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। শীতের রাত, প্রচুর অন্ধকার। এই রাতে নিজের শরীর পর্যন্ত দেখা উপায় নেই। শুধু আশপাশের লোক গুলোর কন্ঠ শুনা যায়। রাস্তার মাঝ পথে আমাকে আটক করে কয়েকটি লোক। ওদের সকলের মুখে মাঙ্কি টুপি পড়া ছিলো।
আটক করে ওরা আমার চোখ বাঁধলো। আমার মাথায় থাকা মাফলার দিয়ে আরোও শক্ত করে চোখ-মুখ বেঁধে নেয়। আমার গায়ের জ্যাকেট কেটে কয়েক টুকরো করে শক্ত করে বাঁধে। এবার রাস্তা থেকে সোজা জমির দিকে আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যায়। আমার মনে মৃত্যুর ভয়, তবে-সাহস হারাইনি।
ওরা যখন আমাকে রাস্তা থেকে নামিয়ে দোলায় জমিতে কাৎ করে শোয়ায় আর আমার কানে বলে তোকে আজ জবাই করা হবে, তখন নিজের মনের ভিতর ভেসে আসে অজানা আওয়াজ। ওরা বলতে থাকে তুই সাংবাদিক হইচোস না ৫টাকার কলমের কালি চারআনা তো নিউজটা লেখতে গিয়ে শেষ করচ্ছিস, নিউজটা যাতে না হয় তোকে তো বলা হইছে কথা শুনিসনি, দ্যাখ জীবন গেলে কি রকম লাগে। টাকার প্রস্তাব দেওয়া হইছে কথা শুনিসনি দে এ্যালা জীবনটা দিয়ে দে!
ধারালো অস্ত্র বুকের উপর আর আমার পায়ে ও ঘাড়ের উপর কয়েকজন মাটিমুখে চাপ দিতে থাকে, যেন আমি নড়তে না পারি। আমি জানলাম কিছুক্ষন পর আমার মৃত্যু হবে। পরিবারের সকলের চেহারাটা কেবল মনে ভাসতে লাগলো, এদিকে ভয়ে শরীরটা শীতল হয়ে আসছে, এতো কিছু ভাবার সময় নেই জেনেও মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলাম। জীবনের শেষ সন্ধ্যা নামছে আমার, যাক কি হয় হবে। আমাকে তো জবাই করবে এটা ভেবে নিজের মুখ আর বুক এক সাথে চেপে ধরে থাকলাম, নিমেশেই ধারালো অস্ত্র গলার উপর দিয়ে চলে গেলো। তবু আমি মুখ আর বুক আলাদা করিনি। ফসাৎ অথবা কিচির ধরনে শব্দ গেলো কানে। প্রথম ছুরিটা আমার ঠোঁটের নিচে থুতনি দিয়ে চলে যায়। তারপর ডান হাত গলার জায়গায় চেপে ধরি ২য় বারের মতো ছুরির চাওয়া পাওয়া মিটাতে থাকে। সর্বশেষ বাম হাত গলা রক্ষাতে চেপে ধরে থাকি। ক্ষুদার্থ ধারালো অস্ত্র এবার তার তৃপ্তি মিটায়। ঠিক গরুকে যেভাবে জবাই করে সেই ভাবে আমার গলার উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। তিনবার ছুরি চালানো হয় গলায়।
আমি জানি আর কোন ভাবে আমার গলাকে রক্ষা করতো পারবো না। রক্ষা করার মতো আমার দেহের তিন রক্ষাবাজ এখন রক্তাত্ব হয়ে গেছে! থিয়েটারের সাথে কিছুটা যুক্ত ছিলাম তাই থিয়েটারের কায়দায় আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে গঙ্গারি ছেড়ে একটু নিজে থেকে সব শক্তি দিয়ে উঠতে চেষ্ঠা চালাই। তখন খুব নিরুপায় মনে হচ্ছিলো।
কেননা, আমি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে দিকে যাচ্ছি। এমন সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ওরা কি যেন ভেবে আমাকে সেই অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। মনে হয় টসলাইট দিয়ে ভালো করে আমার গলার দিকে দেখেনি। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় হয়তোবা আমার পাশ দিয়ে সেদিন কোন বিষাক্ত সাপও চলে গেলে। আমি টের পাইনি। আউদিয়ার বিলের ফাঁকা জায়গায় রাস্তার দক্ষিণের জমিতে আমার নিথর দেহ পড়ে থাকে।
আমার যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন রাত একটা বা দেড়টা হবে। জমিন থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, কিন্তু শরীরে শক্তি টুকু নাই। তার উপর আবার হাত-পা বাঁধা। প্রচুর যন্ত্রণা হচ্ছে, রক্ত ঝরতে থাকে। শরীর জুড়ে শেষ বিদায় নেবার টান। তবুও যেন মনের ভিতর বেঁচে থাকার নিশ্বাস দিতে থাকে। জনমানব শূন্য জায়গায় কি করবো তা ভাবতে শুরু করলাম। সর্তকে কান পেতে থাকি এই ভেবে যে, ওরা পাশে আসে কি’না। তাদের কোন আওয়াজ ভেসে আসে কিনা। চারিদিকে ব্যাঙ আর ঝিঝি পোকার ডাক শুনি।
আবার নতুন করে ভাবনা মনে নাড়া দেয়। ওরা যদি আমার লাশ গুম করার জন্য আবার আসে, তাই দ্রুত ভাবে কোন রকম হামাগুড়ি দিতে থাকি। আমার হাতের কেটে যাওয়া রক্তাক্ত আঙ্গুলগুলো মাটিতে ও জমির ধানে নাড়াতে যখন লাগতে থাকে, প্রচুর কষ্ট হয় মনে হয় এইবুজি দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিলাম। (আরো অনেক ঘটনা যা লেখতে পারছিনা)
একেবারে নীরব এলাকা, জনমানবের সাড়া শব্দ নেই, তারপরেও শেষ রাতের পথচারিরা আমাকে উদ্ধার করে আমার পরিবারের কাছে দিয়ে যায়।
অনেকের দোয়া ভালোবাসা ও সহযোগিতায় দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে প্রাণে বেঁচে যাই। আজ আমার প্রথম মৃত্যূ ২য় জীবনের ১৩বছর…।
[হেলাল হোসেন কবির, কবি ও সাংবাদিক, লালমনিরহাট]